বালি : প্রকৃতির এক অনবদ্য শৈল্পিক সৃষ্টি।

      
                                               
ইন্দোনেশিয়ার বালি, প্রকৃতির এক অনবদ্য  শৈল্পিক সৃষ্টি। পাহাড়, সমুদ্র, নদী থেকে শুরু করে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, দুর্গম জঙ্গল, সুজলা-সুফলা ধানক্ষেত কি নেই  এই বালিতে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল দেশের মানুষদের উদারমনে স্বাগত জানায় বালি।
প্রথমেই বলি সমুদ্র সৈকত এর কথা। এখানে বেশ কিছু পাবলিক বিচ এবং প্রাইভেট বিচ আছে।
কুটা  বিচ , সেমিন্যাক বিচ ,জিমবারান বিচ , ডাবল সিক্স বিচ এগুলা হলো পাবলিক বিচ । কুটা  বিচ অনেক ভিড়। বেশিরভাগি ব্যাকপ্যাকের সিঙ্গেল বা গ্রুপ টুরিস্ট এসে এইখানে থাকে । কুটা বিচ এর থেকে সেমিন্যাক বিচ টা সুন্দর এবং পরিষ্কার । কুটা আর সেমিন্যাক এর মাঝে ডাবল সিক্স বিচ । প্রাইভেট বিচ গুলোর মধ্যে আছে পান্ডাওয়া বিচ, ড্রীমল্যান্ড, পাদাং পাদাং বিচ  এবং আরো অনেক।
ডাবল সিক্স বিচ এ সমুদ্র এর পাড়ে অনেক রেস্টুরেন্ট আছে। যেগুলো বিচ এ বিন ব্যাগ দিয়ে বসানোর ব্যবস্থা  এবং  লাইভ গান এর ব্যবস্থা  আছে। এর মধ্যে লা প্লানচে রেস্টুরেন্ট টা অন্যতম। রিলাক্স মুডে সূর্যাস্ত উপভোগের জন্য একদম পারফেক্ট একটা জায়গা। ফেইসবুক বা ইনস্টাগ্রাম এর জন্য আপনার একটা ভালো ছবি উঠবে এটা কন্ফার্ম । তবে ছবি তুলার পর পরিবেশ টা  উপভোগ করতে ভুলবেন না।
            
জিমবারান বিচে সী ফুড দিয়ে  রাতের খাবার মিস করার মতো নয় । চমৎকার পরিবেশ সাথে ভ্রাম্যমান গানের গ্রুপ ও থাকে । মিলিয়ন ডলার (!) দামের রোমান্টিক ডিনার করতে পারেন আপনার সঙ্গী কে সাথে নিয়ে । একটা অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। আমরা ডিনার করেছিলাম Kampoeng Seafood নামের একটি রেস্টুরেন্টে।
খাবার অসম্ভব মজাদার ছিল। আর ভালো কথা খাবার এর দাম এ কিছু ডিসকাউন্ট দিতে বললে ওরা  ভ্যাট বাদ দেয় অনেক সময়, তাই ডিসকাউন্ট চাইতে ভুলবেন না, ভাগ্য ভালো থাকলে পেয়েও যেতে পারেন। আর বালি Hai Sunset Dinner Cruise টাও ভালো তবে একটু ব্যায়বহুল।
নুসা দুআ বলে বালিতে একটি জায়গা আছে । এখান থেকেই সাধারণত বিভিন্ন ওয়াটার স্পোর্টস পরিচালনা করা হয় । সী ওয়াকিং, স্কুবা ডাইভিং, স্নোর্কেলিং, প্যারাসেইলিং, ফ্লাইং ফিশ , জেট স্কী, আন্ডার ওয়াটার স্কুটার, আইল্যান্ড হপিং, বানানা বোট সহ আরো অনেক ধরণের স্পোর্টস আছে । স্কুবা ডাইভিং বাদে বেশিরভাগ স্পোর্টস এর জন্যই সাঁতার জানার প্রয়োজন নাই। এছাড়া উবুদে আছে  হোয়াট ওয়াটার রাফটিং এর বেবস্থা। তেলাগা ওয়াজা নদীতে প্রায় ১৮ কি.মি. রাফটিং এবং আয়ুঙ নদীতে প্রায় ১৪ কি.মি. রাফটিং এর ব্যবস্থা আছে। হোটেল এর লৰিতে অথবা স্ট্রিট মার্কেটে অনেক ওয়াটার স্পোর্টস প্যাকেজের স্টোর আছে । সব জায়গার মতো বিদেশিদের জন্য দাম একটু বেশি রাখে। একটু দামাদামি করে নিলে ভালো ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। আর কিছু করেন বা না করেন আমি বলবো প্যারাসেইলিং, সী ওয়াকিং আর ওয়াটার রাফটিং অবশ্যই করতে কারণ এটা অন্যরকম একটা ভালো লাগা তৈরি করে মনে।
             
ইন্দোনেশিয়া মুসলিম প্রধান দেশ হলেও বালি হিন্দু প্রধান দ্বীপ। বালি তে রয়েছে দেখার মতো অনেক মন্দির। আগুনগ বিসাইক হলো সবচেয়ে বড় মন্দির। উলুওয়াতু ওয়াটার, তানাহ লট, উলুন দানু বাটুর ,পুরা তিরতা এম্পুল, তামান আয়ুন, পুরা আগুনগ বিসাইক, উলুন দানু, পুরা তিরতা এম্পুল, গোআ গাজা, গুনুগ কাওয়ি মন্দিরসহ আরো অনেক। সব গুলুতেই এন্ট্রান্স ফি দিতে হয়। এর মধ্যে তানহা লট আর উলুওয়াতু ওয়াটার মন্দির এ সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা সত্যি অসাধারণ। সাথে উলুওয়াতু এর কেজাক ডান্স শো পুরা সময় টাকে অপার্থিব করে তুলে। পুরা তিরতা এম্পুল এ রয়েছে পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করার ব্যবস্থা। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে এসে ওই পবিত্র পানি দিয়ে একবার হলেও গোসল করে। আর পাহাড় এর পাদদেশে উলুন দানু মন্দির টাও দেখার মতো।
এছাড়া GWK নামে একটা কালচারাল পার্ক আছে যেখানে আপনি হিন্দু দেবতা বিষ্ণু এর ৭৫.৫ফিট উঁচু মূর্তি ও পৌরাণিক পাখির মূর্তি দেখতে পাবেন। সাথে বিকালে শুরু হয় বালির ঐতিজ্যবাহী বালিনীয় নাচ আর সঙ্গীত। এখানে যেতে হলেও আপনাকে টিকেট করতে হবে।
 বালিতে অনেক প্রাকৃতিক ঝর্ণা আছে। তেগেনুজ্ঞান, গিটগিট ঝর্ণা এর মধ্যে অন্যতম। গিটগিট ঝর্ণা টা একটু দূরেই। দূরে যাবার সময় না পেলে তেগেনুজ্ঞান টাই ঘুরে আসতে পারেন। অনেকেই ঝর্ণার পানিতে গোসল করেন কিন্তু সাবধান, ঝর্ণার একপাশে ডেঞ্জার জোন আছে ঐ জায়গাটা খেয়াল রাখবেন। কোনো সমস্যা হলে লাইফ গাইর্ড আছে তাকে বলবেন। এবং তারা যথেষ্ট উদ্দমী।
             
এরপর আসি জীবন্ত আগ্নেয়গিরিতে। মাউন্ট বাটুর । মাউন্ট বাটুর এ হাইকিং এর জন্য অন্যতম পরিচিত একটা নাম । হাইকিং শুরু হয় রাত ১১ টা থেকে । প্রথমে আপনাকে  হোটেল থেকে বেইস ক্যাম্প এ নিয়ে যাবে । এর পর রাত ২:০০/২:৩০ টায়  বেইস ক্যাম্প থেকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধুমাত্র টর্চলাইট এর আলোতে শুরু হয় হাইকিং। ওই সময় তাপমাত্রা  ১৪/১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকে তাই সাথে একটা গরম কাপড় নিয়ে যাবেন। প্রায় ২ থেকে ২.৫ ঘন্টার হাইকিং শেষে আপনি চলে যাবেন মাউন্ট বাটুর এর শীর্ষে। ক্রেটার থেকে হালকা ধোঁয়া  সবসময় বের হতে দেখা যায় । এরপর মেঘের ফাকঁ দিয়ে সূর্যমামা অল্প অল্প করে উঁকি দেয়া শুরু করবে। সূর্যোদয় দেখার পর হাইকিং এর কষ্ট টা পুরোপুরি উবে যায়, এটা ১০০% সত্যি । অসাধারণ দৃশ্য। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। জীবন কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্বর্গীয় মনে হবে।
এরপর আপনাকে নাস্তা হিসেবে কলা-পাউরুটি আর জীবন্ত আগ্নেয়গিরির ধোঁয়াতে সিদ্ধ করা ডিম দেয়া হবে। হাইকিং এ যাবার প্রয়োজনীয় জুতা আর কাপড় সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। যেদিন  হাইকিং এ যাবেন তার আগের দিন বা ওই দিন সকাল থেকে  বিশ্রামে থাকলে হাইকিং টা খুব কষ্টকর হবেনা। হাইকিং এর জন্য অবশ্যই ফিটনেস টা জরুরী সাথে যারা একটু ভীতু প্রকৃতির তারা না গেলেই ভালো। আর জরুরী অবস্থার জন্য সাথে কিছু পেইনকিলার, অমিপ্ল্যাজাল আর মাসল রিলাক্সেশন এর ঔষুধ সাথে রাখতে পারেন।
যারা হাইকিং করতে চান না কিন্তু সূর্যোদয় দেখতে চান , তারা কিন্তমানি নামের জায়গাটা তে এক রাত থাকতে পারেন। ওখানে বেশ কিছু হোটেল আর রেস্টুরেন্ট আছে । The Cave হোটেলটা  অসাধারণ, বারান্দা থেকে সকালে সূর্যোদয় ও মাউন্ট বাটুর আগ্নেয়গিরি দেখার জন্য। Lakeview Restaurant টাও ভালো মাউন্ট বাটুর আগ্নেয়গিরি দেখার জন্য। তবে The Cave হোটেল এর বারান্দা থেকে সকালে সূর্যোদয় এর সময় আগ্নেয়গিরি, লেক বাটুর আর মেঘেদের যে অবিশাস্য রূপ দেখা যায়  তা কখনো ভোলার নয়। সাথে আপনি চাইলে হোটেল এর দেয়া সকালের নাস্তা টাও  সেরে নিতে পারেন ওই নয়নাভিরাম পরিবেশে। কিন্তামনিতে সব রেস্টুরেন্ট রাত ৮.৩০-৯ টার মাঝেই বন্ধ হয়ে যায় তাই রাতের খাবার টা আগেই সেরে নেয়া ভালো।
মেঘমল্লিকার মাঝে দিয়ে সূর্য্য দেখা, সাথে আগ্নেয়গিরি আর লেক এর সৌন্দর্য, পাখির উড়ে যাওয়া, মেঘ এসে ছুঁয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দেয়া সে এক অচিনপুরের অপার্থিব অভিজ্ঞতা। লেক বাটুর এর কাছে হট ওয়াটার স্প্রিং আছে, ওখানে গোসল করার ব্যবস্থাও আছে। সাথে বেশ কিছু  রেস্টুরেন্ট ও আছে। বালিতে জুন, জুলাই এর দিকে যাওয়া ভালো, তাছাড়া বেশির ভাগ সময় বৃষ্টি এবং মেঘে ঢাকা থাকে। আর কেউ যদি সূর্যোদয় দেখতে না চান তবে বিকেলের আগে যে কোনো সময়ে পাবলিক ভিউ পয়েন্ট থেকেও মাউন্ট বাটুর ও লেক বাটুর দেখে আসতে পারেন।
            
এগুলো ছাড়াও আরো অনেক জায়গা আছে যেমন মাংকি ফরেস্ট, সাফারি পার্ক, উবুদ প্যালেস, রাইস টেরাস প্রভিতি। রাইস টেরাস হলো আমাদের দেশের ধান ক্ষেত আর চা বাগান এর মিলিত রূপ। চা বাগান এর মতো পাহাড়ে ধাপে ধাপে তৈরী করা হয় ধান ক্ষেত। অন্যরকম এক সৌন্দর্য। হয়তবা চাইলে আমাদের দেশেও গড়ে তোলা সম্ভব রাইস টেরাস।
আর মাংকি ফরেস্ট এ শুধু বানর আর বানর, যারা বানর পছন্দ করেন তারা মজাই পাবেন এখানে গেলে , তবে সাবধান হাতে ব্যাগ না রেখে কাঁধে রাখাই ভালো নয়তো বানর বন্ধূরা কেঁড়ে নিতে পারে। মাংকি ফরেস্ট এর পাশে স্ট্রীট মার্কেট আছে, হেঁটে উপভোগ করতে পারেন সাথে কিনে নিতে পারেন পছন্দনীয় জিনিস। উবুদ এ Biah Biah বলে একটা রেস্টুরেন্ট এর খাবার ভালো, চাইলে আপনি হাঁসের মাংস ও খেতে পারেন তবে একদিন আগেই বুকিং দিতে হবে এছাড়া বালির ট্রাডিশনাল ডিশ আর  পানীয় ট্রাই করতে পারেন।
বালি বেশ বড় একটা দ্বীপ, এর কাছে আরো বেশ কিছু  সুন্দর ছোট ছোট দ্বীপ আছে। গিলি এর মাঝে অন্যতম। ২-৩ ঘণ্টা নৌকা করে যেতে হয়. দ্বীপ গুলোতে গিয়ে থাকার ব্যবস্থাও আছে।
বালিতে শপিং করতে পারেন, এদের বুটিক শপ থেকে, তাছাড়া বিভিন্ন মন্দির এর আশেপাশে দোকান আছে সেখান থেকেও কিনতে পারেন কিছুটা সস্তা দামে। বালিনেস ম্যাসাজ আর  স্পা এরও অনেক অপশন পাবেন । সব মিলিয়ে ১০~১২ দিন এর ছুটি নিয়ে আসলে চুটিয়ে উপভোগ করতে পারবেন বালির নানা রূপ আর ঢং।
বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত এর জন্য গাড়ি অথবা মোটরবাইক ভাড়া নিতে পারেন অথবা ড্রাইভার সহ গাড়ি ভাড়া করতে পারেন ১০-১১ ঘন্টার জন্য, খরচ পড়বে ৫০০-৬০০ হাজার ইন্দোনেশিয়ান রুপি। গাড়ি আপনার হোটেল থেকেও ব্যবস্থা করে নিতে পারেন। সারাদিনের জন্যে গাড়ি ভাড়া করে কয়েকটা জায়গা একদিনে ঘুরতে পারলে কিছুটা সাশ্রয় হয়। আর যারা সাইক্লিং পছন্দ করেন তারা সাইক্লিং করে উবুদ ভিলেজ ট্যুর দিতে পারেন।
একটা কথা আবারো বলছি, বালিতে জুন/জুলাই মাসে যাওয়া ভালো নয়তবা বৃষ্টি আপনার ট্যুর মাটি করে দিতে পারে আর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ফোন নম্বর এবং ঔষুধ নিতে ভুলবেন না।
পৃথিবীর সকল জায়গা থেকেই সব ধর্মের মানুষ বালিতে  আসে। সবাইকেই বালি সমানভাবেই দেখে। আপনিও সবাইকে এবং সব ধর্ম আর সবার কালচারকেই সম্মান করুন। ভালোবাসুন এবং ভালো থাকুন।
Please follow and like us:

Leave a Reply